Wednesday 24 February 2016

অনির ডাইরি ১১ই জানুয়ারী ২০১৬


আমার এক সহযাত্রী আছেন, সান্যাল বাবু,উনি হলোকাস্টের ওপর একটি উপন্যাস রচনা করছেন একজন ভেতো বঙ্গসন্তানের পক্ষে হলোকাস্ট নিয়ে এক কলম লেখাও সহজ নয় শুধুমাত্র কনশেনট্রেশন ক্যাম্প, নির্বিচারে ইহুদী হত্যা আর অ্যান ফ্রাঙ্কের ডাইরি এর বেশি হলোকাস্টের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি কই? কিন্তু সান্যাল বাবু তাঁর রচনা নিয়ে অত্যন্ত প্যাসনেট উনি দৈনন্দিন ব্যস্ততার মধ্যেও এই নিয়ে প্রভূত পড়াশোনা করেন জার্মান,পোলিশ না না ভাষার সিনেমা দেখেন, সময়কালকে অনুভব করার জন্য 
উনি হলোকাস্ট নিয়ে তথা ওণার সদ্যলব্ধ জ্ঞান নিয়ে সদাই জনচর্চা করেন সাম্প্রতিক উনি একটি গুণমুগ্ধ শ্রোতা পেয়েছেন ইতিহাসের সঙ্গে আমার আশৈশব প্রেম যদিও আমি ইতিহাসের ছাত্রী নই ওণার মুখে সে যুগের গল্প আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি বাড়ি ফিরে শৌভিক এবং তুত্তুরিকে শোনাই শৌভিক বাধ্য শ্রোতা বটে তবে তুত্তুরি বড়ই অসহিষ্ণু হিটলারের নামে কোন অকথা কুকথা শুনতে রাজি নয় প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমার বাবার ডাকনাম হিটলার শুধু সেই বাচ্চা মেয়েটির প্রতি ওর বড় টান প্রায় বলে ওকে কেন মেরে ফেলল? অ্যান ফ্রাঙ্কের এমনই যাদু 

যাই হোক সাম্প্রতিক সান্যাল বাবু ওণার বিপুল সংগ্রহ থেকে কিছু সিনেমা ধার দিয়েছেন অবশ্য শর্ত এই যে সিনেমা গুলি দেখতে হবে এবং সম্পর্কিত ওনার প্রশ্নাবলীর সম্মুখীন হতে হবে দোনামোনা করে বললাম, এক নাগাড়ে অনেকগুলি সিনেমা দেখার ধৈর্য্য আমার নাই তাছাড়া তুত্তুরি সে অনুমতি দেবে না দ্বিতীয়ত ভায়োলেন্স আমার সয় না শ্লিন্ডডার্স লিস্ট আমি শেষ করতে পারিনি যেটুকু দেখেছিলাম,সেটাও দীর্ঘদিন আমায় তাড়িত করেছিল

ওনার নির্দেশ মোতাবেক প্রথম সিনেমা দেখলাম, “ডাউনফল হিটলারের জীবনের অন্তিম কয়েকদিনের গল্প ২৪শে এপ্রিল ১৯৪৫ থেকে গল্পের শুরু লাল ফৌজ বার্লিন থেকে মাত্র ১২ কিমি দূরে আছে রাশিয়ান আর্টিলারির গোলায় বার্লিন প্রায় ধ্বংসস্তূপ জার্মান বাহিনী পর্যুদস্ত অথচ পিছু হটার অনুমতি নেই মহান ফুয়েরার নখদন্তহীন সিংহ, তবু তেজ একটুও কমেনি এখানে হিটলারের অসহায় মানবিক রূপ অধিক দৃশ্যমান একদিকে জেদী একনায়ক, সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতাদের কথা কানেই তুলছেন না, ওপরদিকে নিজের তরুণী সেক্রেটারির সঙ্গে স্নেহশীল পিতার মত আচরণ করছেন পরাজয় আসন্ন বুঝে ওণার বিশ্বস্ত সেনানায়করা ওণাকে বারংবার অনুরোধ করে বার্লিন ত্যাগ করার জন্য উনি রাজী হননি সেনাপতি মঙ্কে ওণাকে আশ্বস্ত করে যে শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও বার্লিনকে রক্ষা করা হবে, শুধু মহিলা, শিশু,বৃদ্ধ এবং আহতদের বার্লিন ত্যাগ করার অনুমতি দেওয়া হোক উনি তাতে রাজি হননি হিটলারের মতে যুদ্ধে কোন সিভিলিয়ান থাকে না জার্মান জাতি তাদের এই পরিণতি নিজেরা ডেকে এনেছে যুদ্ধে আহত জার্মান সৈন্যদের নির্বিচারে হত্যা করা হয় ১২-১৪বছরের বালক বালিকাদের হাতে বাজুকা কামান তুলে দেওয়া হয়, রাশিয়ান সৈন্যদের মোকাবিলা করার জন্য 

পরাজয় সমীপে বুঝে ফুয়েরার সিদ্ধান্ত নেন উনি আত্মহত্যা করবেন সঙ্গী চিরসাথী ইভা ব্রাউন মৃত্যুর পূর্বে মিনিস্টার ডেকে বিবাহজালে আবদ্ধ হলেন দোহে আগে হিটলারের প্রিয় কুকুর ব্লন্ডিকে সাইনাইড ক্যাপসুল খাওয়ানো হল এবার হিটলার আর ইভার পালা ফুয়েরারে পছন্দ গলায় পিস্তলের নল ঢুকিয়ে আলতো করে ট্রিগার দাবানো, ইভার তাতে ভয়ানক আপত্তি মৃত্যুর পর সুন্দরি থাকতে চান তাই পটাসিয়াম সায়নাইড বিশ্বাসী বডিগার্ডকে হিটলার নির্দেশ দিলেন মৃত্যুর পরও ওণার দেহ যেন রাশিয়ানরা স্পর্শ করতে না পারে, দাহ করা হয় যেন ওণাদের নশ্বর শরীর ইতিমধ্যে অস্ত্রের ভাঁড়ার খালি একে একে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন ওণার প্রিয়পাত্রেরা হিমলার আত্মসমর্পণ করেছে মিত্রপক্ষের কাছে এমনকি হিটলারের বাঁ হাত গোয়েরিং অবধি এই সুযোগে ক্ষমতাদখল করতে উদ্যোগী হয়েছে ক্ষুব্ধ আহত হিটলার নির্দেশ দিলেন গোয়েবল্সকেও সপরিবারে বার্লিন ত্যাগ করতে কাঁদতে কাঁদতে গোয়েবলস্ জানালেন ফুয়েরারের সব নির্দেশ তিনি আঁখি বন্ধ করে শুনেছেন, কিন্তু এই দুর্দিনে তিনি তাঁর ফুয়েরারকে পরিত্যাগ করতে নাচার গোয়েবলসের স্ত্রী মাগদা নিজ হাতে তার ছয় শিশু সন্তানকে বিষপান করালেন অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ হিটলার আর ইভা সকলকে বিদায় জানিয়ে বাঙ্কারে ঢুকলেন ছবি এর পরও কিছুটা এগোয় বার্লিনের সম্পূর্ণ পতনের সাথে ছবি শেষ হয় 
নেশাগ্রস্তের মত আড়াই ঘন্টা হাঁ করে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে রইলাম বহুদিন বাদে এত ভাল সিনেমা দেখলাম যে জার্মান অভিনেতা হিটলারের চরিত্রচিত্রণ করেছেন তাকে শত কুর্ণিশ ভাললাগার রেশটা রয়েই গেছে

Thursday 31 December 2015

বিনি


ফাঁকা মাঠ, মিষ্টি শিরশিরে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। দূরে নিওন জ্বলা রাজপথ। বাবা পকেট থেকে এক প্যাকেট বিস্কিট আর এক বোতল জল বার করে মাটিতে রাখল। বাবার গায়ে লেপটে আছি। খুব ভাল লাগছে। কি মিষ্টি গন্ধ বাবার গায়ে, মায়ের মত মূল্যবান পারফিউম লাগায় না, পাউডার পর্যন্ত লাগায় না, তাও কেমন যেন অদ্ভুত ভালবাসার গন্ধ বাবার শরীরে। খানিকক্ষণ নীরব থাকার পর, বাবা বলল, “ ফ্রিসবি খেলবি বিনি?” উল্লাসে লাফিয়ে উঠলাম, ঈশ কতদিন ফ্রিসবি খেলিনি। উফ বিলুটা থাকলে খুব মজা হত। বিলু আমার ভাই। সহোদর নয়, তাঁর থেকেও অনেক বেশি। হুশ করে বাবা ছুঁড়ে দিল, দৌড়লাম ধরতে, মোটা হয়ে গেছি নির্ঘাত, আগের দ্রুততা আর নেই। হাঁফ ধরে যাচ্ছে, অব্যবহারে জঙ ধরে গেছে গাঁটে গাঁটে। চোখটাও গেছে, অন্ধকারে ঠাওর করতে সময় লাগছে। বেশ কয়েক দান খেলা হল, ক্লান্ত লাগলেও মজা লাগছে খুব, নাচছি আমি। এই রে এবারেরটা বেশ জোরেই ছুঁড়েছে, বাবা, এক ঝলক বাবার দিকে তাকিয়ে দৌড়ালাম ওটা ধরতে। ফ্রিসবিটা কুড়িয়েছি সবে, হঠাত দেখি, আমাদের গাড়িটা স্টার্ট দিল। এইরে, এখুনি ফিরতে হবে নাকি? কি ভাল লাগছিল! মাথা নিছু করে গুটগুট করে হাঁটা লাগালাম গাড়ির দিকে, একি? গাড়িটা যে আমায় না নিয়েই চলে যাচ্ছে? “বাবাআআআআ” খুব জোরে হাঁক পাড়লাম। গাড়িটা দাঁড়ালো না তো। হে ঠাকুর এ কি হল? প্রাণপণে দৌড়ালাম গাড়ির পিছনে। “বাবাআআ! ড্রাইভার কাকুউউউউ।” গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড়চ্ছি রাজপথ ধরে, দৌড়তেই থাকলাম, যতক্ষণ গাড়িটা চোখে পড়ল। চোখের আড়াল হবার পরও উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়চ্ছিলাম, দম ফুরিয়ে আসছিল, কে যেন বলল, “আরে?? গাড়ি চাপা পড়ে মরার শখ হয়েছে না কি রে??”  
বাবা তাহলে আমায় রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে গেল? ডুগরে ডুগরে কাঁদতে লাগলাম। এই ছিল আমার কপালে? অবশ্য যার নিজের মাই তাকে বেচে দেয়, সে পরের থেকে কি প্রত্যাশা করবে? জন্মদাত্রীর কথা আর মনেই পড়ে না। কতদিনই বা পেয়েছি তাকে? আমার বয়স যখন সাত দিন, মায়ের বাবু আমায় বেচে দেয়। এই বাবা মা, কম্বলে মুড়ে আমায় নিয়ে আসে আমাদের বাড়ি। কি ভাল বাসত এরা আমায়। বাবা মায়ের বিয়ের চার বছর পরেও ওদের কোন সন্তান হয়নি, মা নাকি একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছিল ডিপ্রেশনের চোরাবালিতে। আমিই নাকি মাকে তুলে আনি, সেই অতল চোরাবালি থেকে। কি ভাল কেটেছিল কটা বছর। রাতে বাবা মার মাঝে শুতাম। সারা রাত ওদের ওমে তফা ঘুম হত। হটাত একদিন খেয়াল করলাম, মা বেশ মোটা হয়ে গেছে। অল্পেই হাঁপিয়ে পড়ছে। আমাকে আর কোলে নিচ্ছে না। গায়ে হাত দিলেই আঁতকে উঠছে, “বিনি দূরে থাক।” মাস্টার বেডরুমে আমার শোয়া বন্ধ হয়ে গেল। কিছুদিন বাদে, মা কোথায় যেন গেল। বাবাও আর আমার দিকে ধ্যান দিত না। কাজের মাসি অবশ্য যত্ন নিত খুবই। জানতাম সবই মায়ের নির্দেশ। আমার সব কিছুই মায়ের নজরে থাকে। তবু, মায়ের জন্য রাতে কাঁদতাম। পাঁচ সাত দিনের মধ্যেই মা ফিরে এল, কোলে একটা পুটু। বাবা কোলে করে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিল, “তোমার ভাই। বিলু।” ভাই? আমার ভাই? এত ছোট্ট? যে তুলোর পুতুল গুলোকে আমার ছিঁড়তে হেব্বি মজা লাগে, ঠিক তাদের মত দেখতে। পুটুস পুটুস চায়, খিলখিলিয়ে হাসে। গায়ে হাত দিতে গেলাম, মা আঁতকে উঠল, “বিনিইইই। ছিঃ। গায়ে হাত দিও না। দূরে থাক।”একটা চুমু খাবার অদম্য ইচ্ছে দমন করে মাথা নিচু করে চলে আসছিলাম, বাবা অট্টহাস্য করে আবার কোলে তুলে নিল। “বিনি ও বড্ড ছোট বাবু। একটু বড় হলেই তোর সাথে খেলবে। মন খারাপ করে না সোনা।”
আমি বাবার সাথে শুতাম, আর বিলু মায়ের সাথে। বিলুর দু বছর হতেই, আমরা দু ভাইবোন এক ঘরে শোয়া শুরু করলাম। কি যে অসম্ভব ভালবাসতাম বিলুকে। সারা ক্ষণ বিলুর ছায়াসঙ্গী ছিলাম আমি। বিলু যে আমার ভাগের আদর ভালবাসা অনেকটাই দখল করে নিয়েছে, সেটা বুঝতাম। তাতে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস ছিল না। ছোট্ট বিলু কেমন দিনে দিনে বড় হয়ে উঠল। স্কুলে যেতে লাগল। একটা পুঁচকে বান্ধবীও হল। সব গোপন কথা শুধু আমাকে বলত, আমার ভাই বিলু।
কিছুদিন হল, হাতে পায়ে তেমন জোর পাচ্ছিলাম না। অল্পেতেই হাঁপিয়ে পড়ছিলাম। বিলুর সাথে তাল মিলিয়ে দস্যিপনা করতে পারছিলাম না। মা খালি বলত, “বিনি দিনদিন এত অলস হয়ে পরছিস কেন?” খালি শুয়ে থাকতে ভাল লাগত। আর কি চুল উঠছিল, বাপরে বাপ। গোটা বাড়ি ময় আমার চুল। সাথে সাথে পেটের গণ্ডগোল। যত্র তত্র হয়ে যেত। ছোট এবং বড় উভয়ই, মা আর কাজের মাসি পাগল হয়ে যেত সাফাই করতে করতে। বাবা ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গেল, মুখপোড়া ডাক্তার ঠিক করতেই পারল না। মায়ের ভালবাসা ক্রমশ কমে আসছিল। বোঝা হয়ে পড়ছিলাম আমি। আমাকে দেখলেই মা আজকাল মুখ ঝামটা মারত।আজ তো লাঠির বাড়ি এক ঘা বসিয়ে দিল। বিলু স্কুলে যাবে, তাই ওকে গরম ভাত, মাখন আর ডিম সিদ্ধ করে তাড়াতাড়ি খাওয়াতে বসেছিল মা, মুহূর্তের জন্য উঠেছে, ফোন এসেছে বলে, অমনি আমি গিয়ে ভাতটা খেয়ে নিয়েছি। কেন যে খেলাম? বিলুর মুখের ভাত। গোটাটা খেতেও পারলাম না। শুধু শুধু এঁটো করলাম। মাখন, ডিম পেটেও সইল না, ড্রয়িং রুমটা নোংরা করলাম।
মায়ের হাতে মার খেয়ে চুপ করে মাটিতে বসেছিলাম। বাবা অফিস থেকে ফিরল। ফিরতেই মা এক গাদা নালিশ করল আমার নামে। খানিক ক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বাবা বলল, “চল বিনি। একটু ফ্রেশ হাওয়া খেয়ে আসি।” ভয়ে ভয়ে তাকালাম, মা রান্নাঘরে, বিলু পড়ছে, বাবার সাথে বেড়িয়ে পরলাম।

          আজ দুদিন হয়ে গেল, কিছু খাইনি। কি খাব? বাবার রেখে যাওয়া বিস্কুট আর জল, খুঁজে পাইনি। দৌড়তে দৌড়তে অনেক দূর চলে এসেছিলাম, সেই জায়গাটা আর চিনতে পারিনি। সেদিন কেন যে ফুটপাথে এসে উঠলাম? গাড়ি চাপা পড়ে মরলে ভাল হত। খালি মাঝে মাঝে ডুগরে ডুগরে কাঁদি। কে যেন মাথায় হাত বোলাচ্ছে, চোখ খুললাম, এক জোড়া কালো মোটা পা, মুখ তুললাম, সুইটি দিদি। এককালে বিলুকে পড়াতেন। মুখ নামিয়ে নিলাম, সুইটি দিদি ছোট্ট স্কার্ট সামলে উবু হয়ে বসল, “এটা কে রে? বিনি নাকি রে?” স্নেহাদ্র কণ্ঠ শুনে, আবার কান্না পাচ্ছে। সামলাতে গিয়েও ডুগরে উঠলাম। বুক ফাটা কান্না বেড়িয়ে এল, মুখ চোখ দিয়ে। “ তোকে এ ভাবে, অসহায় অবস্থায়, রাস্তায় ছেড়ে গেছে, বিনি? ছিঃ। এরা ভদ্রলোক?” সুইটি দিদির পুরুষ বন্ধুটি বলল, “ সুইটি, ফর হেভেন সেক, ডোন্ট স্টার্ট অল দিস। এসব ঝঞ্ঝাটে পরার দরকার কি সোনা? মনে নেই আগের বার কাকিমা কি রকম ক্ষেপে গিয়েছিলেন”  সুইটি দিদিও চলে গেল। যাবার সময়, একটু বিস্কুট রেখে গেল। আমি খাইনি। আশে পাশের কুকুর গুলোকে দিয়ে দিয়েছি। আধঘণ্টা পর,মাথা নিচু করে শুয়ে আছি, দূর থেকে কে যেন ডাকল, “বিনি।” মায়ের মত গলা। জানি মা নয়। আমার কান ভুল শুনছে। থাক, এই স্বপ্নের ঘোরেই থাকি। কিছুতেই চোখ খুলব না।  “বিনিইই” আবার যেন ডাকল মা, মাথায় এ কার হাত। চমকে তাকালাম, মা। মাই তো। অঝোরে কাঁদছে। পিছনে বিলু দাঁড়িয়ে, এক গাল হাসছে। দূরে বাবা ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে। বাবার পাশে, জেলারের মত, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সুইটি দিদি।  মা –আমি এক সাথে কেঁদে উঠলাম। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে আমার নোংরা ধুলি মাখা মাথায় মুখ ঘষছে, আর বলছে, “ নালিশ করলাম, তো অমনি রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। যেন ও আমার মেয়ে নয়, রাস্তার কুত্তা। তোকে খুঁজে না পেলে আমিও বাঁচতাম না বিনি।” আমি চরম আবেগে বলে উঠলাম, “মাআআ।” লোকে অবশ্য শুনল, ভৌ ভৌভৌভৌ। ওমা আমি তো কুকুরই, তবে দিশি নেড়ি নই। খাস জার্মান শেফার্ড মশাই।    
#AmiAni #AninditasBlog

Wednesday 30 December 2015

আমাদের কথা (পর্ব ২-৫)



সেদিন রাতে জেঠু যখন ফিরল না, পরদিন সকালে উৎকণ্ঠিত ঠাকুমা দাদুকে পাঠালো ঠাকুমার দাদার কাছে। ঠাকুমার বাবা আর আমার প্রপিতামহ অর্থাৎ দাদুর বাবা এককালে এক সাথে জাতীয় কংগ্রেস করতেন। আমাদের বাড়ির ভাঙা বৈঠকখানা আর পেতে রাখা বিবর্ণ ফরাশ বহু প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তির পদধূলিধন্য। ঠাকুমার বাপের বাড়িও কিছু কম যেত  না। আমাদের বাড়ি সি আর দাশ আসতেন তো ও বাড়ি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ। পরবর্তী কালে, আমার দাদু কংগ্রেসের নরমপন্থা পরিত্যাগ করে উগ্রপন্থীদদের দলে নাম লেখান। দাদু এবং ঠাকুমার বড় দাদা একসাথেই কলেজে ভর্তি হন।  কিন্তু রাজনৈতিক  মতাদর্শ তথা কার্যকলাপের জন্য দাদু অচীরেই বিতারিত হন।  প্রপিতামহ দাদুকে মেদিনীপুর কলেজে রেখে আসেন, কিন্তু পড়াশোনা জলাঞ্জলি দিয়ে দাদু মেতে ওঠেন দেশোদ্ধারের নেশায়। আগেই বলেছি না, রাজনীতি এবং চাটুজ্যে বাড়ির নাড়ির বন্ধন। কুহকিনীর নেশায় দাদু, জাহাজের খালাসী সেজে পাড়ি দিল সোজা রেঙ্গুন। লক্ষ্য অস্ত্র আমদানি ।  পরিণাম সহজেই অনুমেয়।  পরবর্তী  গন্তব্য মান্দালয় জেল। দাদু যখন জীবনের পরম মূল্যবান্ দিনগুলি দেশোদ্ধারের নামে নষ্ট করছিলেন, ঠাকুমার দাদা ততোদিনে পাশ করে তৎকালীন রিপন কলেজ, যাকে আমরা সুরেন্দ্র নাথ কলেজ নামে চিনি, সেখানে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ততোদিনে উনি পারিবারিক দল অর্থাৎ কংগ্রেসেরও বড় নেতা হয়ে উঠেছেন। বাকিটা শুধু উত্থানের গল্প।  জেঠু যখন নিখোঁজ হলেন, উনি তখন এম পি।

 আমাদের পরিবারের প্রতি ওণার ছিল সীমাহীন অবজ্ঞা । সচেতন ভাবেই এই কুটুম্বিতা উনি অস্বীকার করতেন। এমনকি মেলামেশার  ব্যাপারেও ওণার আপত্তি ছিল। ব্যাপারটা অনুভব করে দাদুও এড়িয়ে যেতেন।  সেদিন অবশ্য পারেননি।  বহু বছর বাদে শ্বশুরবাড়িতে পা দিলেন দাদু। শ্বশুর শাশুড়ি পূর্বেই মৃত।  এমনকি ঠাকুমার ছোট ভাইও মারা গেছেন।  বাবার বড় মামিমা অবশ্য খাতির করেই বসালেন।  কুশল সংবাদ নিতে গিয়ে সব শুনে উনি স্তম্ভিত ।  নিজে গিয়ে ডেকে আনলেন বড় মামাকে।  তিনি শুনেছি বাড়িতে খড়ম পরতেন।  খটখট করতে করতে এসে হাজির হলেন বৈঠকখানায়।  দাদু যে চেয়ারে বসেছিল তার ঠিক ওপরে একটি বিশাল বিলিতি  দেওয়াল ঘড়ি ছিল।  এক নজর সেদিকে তাকিয়ে, জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন,“আজ একটু ব্যস্ত আছি। বিনা অ্যাপয়ন্টমেন্টে বেশি সময় দেওয়া যাবে না। ”
দাদু নিশ্চুপে বসে রইলেন।  বড় মাইমা ব্যস্ত ভাবে বলে উঠলেন,,“ কি বলছ? তোমার বড় ভাগনে কাল থেকে বাড়ি---”
“ তো?আমি পুলিশ না টিকটিকি? প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে।  কাল ফেরেনি।  আজ হয়তো ফিরে আসবে।  ব্যস্ত হবার কি আছে” উনি খিঁচিয়ে উঠলেন।
ওণার কথা শুনে দাদু কেন জানি না, কিছুটা আশ্বস্ত হল।  কাল ফেরেনি, আজ ফিরবে। তার মানে জেঠু অন্তত জীবিত।  যে অমঙ্গল আশঙ্কায় কাল সন্ধ্যা থেকে কেউ জলগ্রহণ করেনি তা হয়তো মিথ্যা শঙ্কা মাত্র।
দাদু উঠে পড়লেন।  বাবার বড় মামা নিরাসক্ত গলায় বললেন,“চললে নাকি? আচ্ছা চল, তোমায় সদর দরজা অবধি এগিয়ে  দি। ” সদর দরজার সামনে এসে দাদু বিদায় জানাবে, উনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,“ এতো হবারই ছিল জামাই। মেজ নকশাল হবার আগে, ভাবা উচিত ছিল”।  দাদুর শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত  বয়ে গেল।  টলে যেতে যেতে থামটা ধরে নিলেন।  সব আশা শেষ।  বড় মামা শীতল সাপের মত হিসহিস করে বললেন,“ মেজটাও রেহাই পাবে না। ” মেজ অর্থাৎ আমার বাবা।


জেঠু নিখোঁজ , বাবা নিরুদ্দেশ।  সাড়ে সাত বিঘা জমির ওপর আমাদের বিশাল পৈত্রিক বাড়ি, যা সব সময় জনসমাগমে জমজমাট থাকে, বিগত দুদিন ধরে খাঁ খাঁ করছে। প্রাণী বলতে আমার বৃদ্ধ দাদু, ঠাকুমা,প্রৌঢ় মেজদাদু, মেজঠাকুমা , ছোটকাকু আর পিসি।  দিন দুয়েক শোকাহত হয়ে কাটার পর তৃতীয় দিন সকালে পিসিকে স্কুলে পাঠান হল। ছোটকাকু সঙ্গে গেল।  সাধারণত পিসি একাই যায়, সেদিন মেজ ঠাকুমার মন কু গাইছিল, তাই পিসির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কাকু সঙ্গে গেল।
অল্পকাল পরেই রুদ্ধশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে ফিরে এল দোহে।  সদর দরজা পেরোতেই একদল অচেনা ছেলে পিছু নিয়েছিল।  নানা কটুকাটব্য কানে আসছিল।  পাড়ার পরিচিত  লোকজন অচেনা মত পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল।  ঝপাঝপ দরজা জানলা দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।  পরিস্থিতি সঙ্গিন বুঝে ছোটকাকু দ্রুত পিসিকে নিয়ে ফিরে আসে।  পিসি অবশ্য তারই মধ্যে ঘুরিয়ে দুটি  গালাগালি ফেরৎ দিয়ে এসেছে।

 যে সদর দরজা সূর্যোদয় থেকে মধ্যরাত্রি অবধি খোলা থাকত, দ্রুত তা বন্ধ হয়ে গেল। থমথমে আতঙ্কের আবহ কুয়াশার মত ঘণ হতে লাগল। সারা দিন কেউ এল না।  সন্ধ্যা গাঢ় হতে, আপাদমস্তক শাল মুড়ি দিয়ে তিনি এলেন।  জেঠুর বাগদত্তা।  বাবা ছোটকাকু পিসির অগ্নিকন্যা। আর আমার নেমসেক রঞ্জাবতী। জেঠু রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক বিবর্জিত হলেও, রঞ্জাবতী ছিল ঘোরতর ভাবে যুক্ত।  প্রেসিডেন্সীর ছাত্রী।  অসম্ভব সাহসী। তখন জিন্স বা ট্রাউজার্স পরার চল ছিল না।  শাড়িকেই মালকোঁচা মেরে পড়ে, ইউনিভার্সিটির বন্ধ গেটে চড়ে পুলিশের সাথে সমানতালে খিস্তিখেউড় করত।  দমাদ্দম পেটো ছুঁড়ত।  মিছিলে পুলিশের সাথে নিয়মিত হাতাহাতি করত। বাবা স্বচক্ষে  দেখেছিল, বাবাদের রঞ্জুদি একবার পুলিশের কাছ থেকে থ্রী নট থ্রী রাইফেল কেড়ে তাই দিয়েই তাকে পেটাচ্ছে। কোন অজ্ঞাত কারণে, রঞ্জুদিকে পুলিশ ধরলেও ঘন্টাখানেকর মধ্যেই ছেড়ে দিত।

 রঞ্জাবতী বাবার খবর এনেছিল।  বাবা নিরাপদেই আছে। খবর পাঠানো হয়েছে। বাবাকে আসতে নিষেধ করা হয়েছে।  কারণ জেঠু ছিল টোপ। উনি সাবধান করে গেলেন, আপাতত বিনা প্রয়োজনে যেন কেউ বাইরে না বের হয়। গোটা মহল্লা ওরা ঘিরে রেখেছে।  বাবার শুভার্থীরা কেউ ঢুকতে পারছে না।  রঞ্জাবতী যন্ত্রের মত কথা বলে যখন চলে যাচ্ছে, ঠাকুমা ওর হাত দুটি   চেপে ধরলেন, “ তুমি জান? বড়?”
রঞ্জাবতী মাথা নাড়ল। কালো শালটা নামিয়ে নিল চোখ অবধি। “কোথায় ? আমরা এখন কি করি? একবার শেষদেখা ও” ঠাকুমার কথা শেষ হবার আগেই উচ্চঃস্বরে কেঁদে ওঠে রঞ্জাবতী। না জেঠুর দেহ পাওয়া যায়নি।  ওণার খণ্ড বিখণ্ড দেহ নাকি ওণার কলেজেরই বিশাল  বাগানে কোথাও পুঁতে দিয়েছিল ওরা। জেঠুর তাই অন্তিম সংস্কার ও হয়নি। জেঠুর ছবিতে কোনদিন মালাও দেওয়া হয়নি।

আমাদের এলাকার তৎকালীন এম এল এর সাথে বাবার এক মৌখিক চুক্তি ছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সিপিএম এবং নকশালদের শান্তিপূর্ণ  সহাবস্থান চুক্তি। দুপক্ষই পোস্টার সাঁটাত। দুদলে খুচখাচ চোরাগোপ্তা মারামারি থাকলেও তা খুনোখুনি ছাড়ুন, হাত পা ভাঙা অবধিও গড়ায়নি। সত্তরের রক্তাক্ত পশ্চিম বঙ্গে ও আমাদের এলাকা ছিল শান্ত।  জেঠুর ওপর আক্রমণ ছিল আদতে বিশ্বাস এবং চুক্তি ভঙ্গ। সমগ্র ঘটনাচক্রের পরিচালক ছিলেন সিপিএম এর জনৈক নেতা শ্রীমান ব্রতীন সেন।  কানাঘুষো শোনা যেত বরানগর কাণ্ড ও ওণার মস্তিষ্কের  ফসল।

আসল লক্ষ্য ছিল আমাদের এই মফঃস্বল শহরের ওপর একছত্র আধিপত্য। যার জন্য ছাত্র তথা কলেজ গুলিকে কব্জা করা বিশেষ দরকার।
যাই হোক জেঠু নিখোঁজ হবার দিন চারেক পরে নজরদারি শিথিল হল।  বেপাড়ার ঠ্যাঙারে বাহিনী নিপাত্তা হয়ে গেল।  দুচারজন অরাজনৈতিক শুভাকাঙ্ক্ষীর আনাগোনাও শুরু হল। পঞ্চম সন্ধ্যায় এসে হাজির হল বাবা।  দলের উপুর্যুপরি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে। ঠাকুমা,  দাদু কিংকর্তব্যবিমূঢ় । শুধু মেজদাদু বলল,“ বেশ করেছিস। কাপুরুষোচিত ভাবে আমরা বাঁচি না।” বাবার প্রত্যাবর্তনের খবর উভয় পক্ষের কাছেই পৌছল। রঞ্জাবতী এসে এক প্রস্থ হূলস্থূল বাঁধালো। বাবার ডান হাত আর বাঁ হাত ভূপাল আর চাঁদু ওরফে গ্যাঁড়া চাঁদু এসে বলে গেল,“ কিচ্ছু চিন্তা নেই গুরু।  আমরা আছি।  পোটেকশন দেবো। ”
কিন্তু এযাত্রা “ পোটেকশন” দেওয়া অত সহজ ছিল না। আমাদের পারিবারিক পুরোহিত ছিলেন ভট্টাচার্য মশাই।  আদতে তিনি স্থানীয় হাই স্কুুলের সংস্কৃত শিক্ষক ছিলেন। বংশানুক্রমে ওণারা আমাদের পুরোহিত। জনসমক্ষে  কংগ্রেস করলেও আদতে নকশালভাবাপন্থী পরিবার।  ওণার কন্যা কণা আমার পিসির সহপাঠী ছিল। সেই দুর্দিনেও কণা নিয়মিত আমাদের বাড়ি আসত এবং খবরাখবর  আনত। স্থানীয় সিপিএম পার্টি অফিসটা ছিল ওদের বাড়ি লাগোয়া। কণাই প্রথম খবর দিল ওরা সাংঘাতিক কিছুর পরিকল্পনা করছে।  বাবার নাম বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। বরানগর মডেলে কিছু পরিকল্পনা হচ্ছে।  দুর্ভাগ্যবশত কণার কথা কেউ যথোচিত গুরুত্বসহকারে নিল না।  
দুচার দিন কাটল। কণা আবার খবর আনল পাড়ায় অনেক বেপাড়ার ছেলে ঢুকেছে।  মহল্লার প্রতিটি সিপিএম বাড়িতেই কুটুম্ব আসছে। এবার আর কণার কথা উড়িয়ে  দেওয়া গেল না।  কারণ ঐ একই কথা শোনা গেল আমাদের প্রাক্তন  এমএলএর মুখেও।  মহঃ ঈশা ছিলেন ঐ মহল্লার দীর্ঘদিনের এমএলএ।  উর্দু ভাষী খানদানী অবাঙালি মুসলমান।  শোনা যায় লতায় পাতায় প্রাক্তন অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি খাঁ সাহেবের বংশধর।  কোটিপতি ব্যবসাদার । খানদানী কংগ্রেস নেতা।  রাজনীতিতে যোগদানের আগে ওণাকে কেউ পাঁচ পিস স্যুট ছাড়া পরতে দেখেনি।  আর জনপ্রতিনিধি হবার পর থেকে ওণার বেশ ছিল আলিগড়ি পাজামা, আদ্দির গিলে করা পাঞ্জাবি আর দোশালা।প্রায় কপর্দকশূন্য হওযা সত্ত্বেও দাদুকে খাতির করতেন হয়তো ওণার রাজনৈতিক অতীতের জন্য। সেদিন মহালয়া।  বাজারে দাদুর সঙ্গে দেখা, ঈশা সাহেব ডেকে বললেন,“বড়দা।  হাওয়া ভাল নয়। ওরা চব্বিশ পরগনা থেকে ঠ্যাঙারে বাহিনী আনছে। খোঁজ নিয়েছি পাড়ার প্রতিটা ঐ পার্টি করা পরিবারে একাধিক ছেলে আশ্রয় নিয়েছে।  জিজ্ঞাসা করলে বলছে ভাগ্না, ভাইঝি জামাই এইসব। প্রমিলা বাহিনীও তৈরি, সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে।   মেজকে যত তাড়াতাড়ি পারেন মহল্লা ছাড়তে বলুন। ”
খবর বাবাদের দলের অগ্রজপ্রতিম নেতার কানেও পৌছেছিল।  ব্যাঙ্ক কর্মচারী সেই নেতা গোপনে বাবাকে বোঝালেন,“ ওদের সঠিক পরিকল্পনা জানি না। তবে আমাদের সোর্স অনুসারে অস্ত্রবল বা জনবল দুদিক থেকেই এই আক্রমণ প্রতিহত করার সামর্থ্য এই মুহূর্তে আমাদের নেই।  ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড টুস্টেপ ব্যাকোয়ার্ড।  তুই আজই এলাকা ছাড়। ”

বাবাকে বিহারের রামগড়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল।  কোলিয়ারি বেল্ট। ওখানকার আইএনটিইউসি নেতা লছমণ সিং বাবাকে শেল্টার দিতে তৈরি ছিল।  রাত দশটায় ট্রেন।  বাবা বলল, “ একবার মাকে বলে আসি। ”
রাত সাড়ে আটটা বাবা খেতে বসেছে, খেয়েই বেড়িয়ে পড়বে, খিড়কির দরজা দিয়ে। হঠাৎ সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের জিপ এসে থামল আমাদের বাড়ির সামনে।  বাবা বুঝল, বড্ড দেরি হয়ে গেছে।


এক ভ্যান পুলিশ সাথে এক ভ্যান ভর্তি সি আর পি। সদর দরজায় সজোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ । ভীত সন্ত্রস্ত বাড়ির মানুষ গুলো, বিশাল সাবেকী বাড়ির কালো রোয়াকে বসে গোগ্রাসে  গিলছিল বাবা,মুখের গরাস টা পাতে নামিয়ে মাথা নীচু করল, শরীরের সব পেশী শিথিল হয়ে এল, ইঙ্গিতে বলল দরজা খুলে দিতে। রোয়াক থেকে নেমে উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা,মেজঠাকুমা মাঝপথে  থমকে  দাঁড়াল, বড় শালবল্লা দিয়ে দমাদ্দম ধাক্কা  পড়ছে সদর দরজায়। মড়মড় করে ভেঙে পড়ল দুটো প্ল্যাঙ্ক। বানের জলের মত ঢুকে এল পুলিশ, সিআরপি। সাথে প্রায় পাঁচ ছশো ছেলে।  বাবাকে মাটিতে ফেলে বেদম প্রহার চলতে লাগল। পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ। হাত পড়ল দাদু, ছোট কাকুর গায়েও। মেজদাদুর পা ভেঙেছিল, কিছুদিন আগে, তখনও পায়ে প্লাস্টার, তাও রেয়াত পেলেন না।  একতলার দালানে যেখানে দাদুকে ঠাসঠাস করে চড় মারছিল ওরা, তার হাতখানেক দূরেই টাঙানো ছিল বৃদ্ধের তাম্রপত্র

 দোতলার বারন্দায় পনেরোটা সুদৃশ্য ফ্রেঞ্চ উয়িন্ডো ছিল, লাল নীল কাঁচ লাগানো, একটি কাঁচও অবশিষ্ট রাখেনি ওরা।  ঠাকুরদার বাবার  বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না, শখের ঝাড়বাতি , মায় শোখিন দেওয়ালগিরি  অবধি ভেঙে খানখান করা হল। পরিকল্পনা মাফিক প্রথম একচোট গণপ্রহারের পর পুলিশ বাবাকে তুলে নিয়ে যায় ভ্যানে তুলবে বলে। ইতিমধ্যে ভ্যানটি পিছিয়ে গেছে প্রায় পৌণে এক কিলোমিটার । গোটা পথে বেদম মার মারা হয়। উদ্দেশ্যে গণপ্রহারে মৃত্যু । হয়তো তাই হত, যদি না এক পাঞ্জাবি সিআরপি হঠাৎ বাধা না দেয়। ততোক্ষণে বাবা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে।  সচেতন ভাবে বারংবার মাথায় আঘাত করছিল ওরা,  সেটা নজরে আসতেই, সিআরপি পঞ্জাবি অফিসারটি ঝাঁপিয়ে অচেতন বাবার শরীরটা কাঁধে তুলে দৌড়।
বাড়িতে তখনও তুলকালাম চলছে। মেজঠাকুমা হাউমাউ  করে কাঁদছিলেন। কিন্তু ঠাকুমা কাঁদেনি। পিসিকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে ঠাকুমা শুধু একটি কথাই বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছিল, “একটা খায়। দুটো নয়। ” ভূলে গেলেন? আমাদের পারিবারিক  অভিশাপ, প্রতি প্রজন্মে একটি করে ছেলে রাজনৈতিক কারণে বলি হয়।

 সংজ্ঞাহীন রক্তাক্ত  বাবার শরীরটাকে লকআপে ঢোকানো হল, বিনা চিকিৎসায়। খানিক বাদে তিনি এলেন,শিবু ঘোষ। লোকাল মাস্টারমাইন্ড এবং বাবার এককালীন মাষ্টারমশাই। ওণার মারফৎ ই এককালে বাবার পরিচয় হয়েছিল মহান মার্ক্স,মহান এঙ্গেলস্, মহান লেনিন তথা মহান স্ট্যালিনের সাথে। গোল বাঁধালেন মহান মাও। দল ভেঙে গেল। কালকের রাজনৈতিক গুরু হয়ে উঠলেন প্রাণঘাতী  শত্রু । তিনি ভেবেছিলেন পুলিশ বাবার লাশ নিয়ে ফিরেছে, প্রাণ আছে দেখে ক্ষোভে, হতাশায় উন্মাদ হয়ে উঠলেন। ওসির দিকে তেড়ে গিয়ে বললেন,“ ওটাকে মেরে ফেলতে পারলেন না। এত করে বোঝালাম”।ওসি গোপাল খাঁড়া মিনমিন করে জবাব দিল,“ কি করব স্যার? পৌণে কিলোমিটার হাঁটালাম, তাও আপনার ছেলেরা কাজ সাবার করতে পারল না। ”

 বলেছিলাম না, আমার পিসি অসম সাহসী ।  সেদিন গোটা বাড়ি তছনছ করে ওরা যখন চলে যাচ্ছিল, পিসি তখন একটা ছেঁড়া  লাল চাড্ডিকে একটা কঞ্চির মাথায় জড়িয়ে নাড়ছিল। সেই উড্ডীন লাল পতাকার দিকে তাকিয়ে কে যেন ব্যঙ্গ  করে বলেছিল ,“বাবা! এতো ভিয়েতনাম চাইল্ড”।
(Writing this is extremely painful and stressful as well. Don't know whether I'll be able to continue or not. However you may read the previous parts in my page)
#AmaderKatha #AninditasBlog
(To be continued)
#Amaderkatha #aninditasblog

http:/ amianindita.blogspot.in
#AninditasBlog

#Aninditasblog #Amader_katha
#turbulent70s #Kolkata

Wednesday 23 December 2015

আমাদের কথা


বাড়িতে জানানো দরকার। খুব ইচ্ছে করছে বাবাকে ফোন করতে, জানি না বাবা কি ভাবে নেবে।  মা নির্ঘাত হাউমাউ  জুড়ে দেবে।পিসিকে করব কি? পিসির যেমন ঠান্ডা মাথা, তেমনি দুদ্ধর্ষ সাহস।   সত্তরের দশকে আমাদের বাড়িতে যখন হামলা হয়েছিল, পিসির তখন কতই বা বয়স? ক্লাস থ্রী/ ফোর।  দিন দশেক আগে জেঠু নিখোঁজ হয়েছেন।  মূল টার্গেট অবশ্য ছিল বাবা।  আমাদের মফঃস্বল শহরের অবিসংবাদিত ছাত্র নেতা ছিল আমার বাবা।  যাঁরা হাত ধরে বাবাকে এই রাজনীতিতে আনে, দীক্ষা দেয়,কালক্রমে তাঁরাই হয়ে ওঠে বাবার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী তথা গুপ্তশত্রু।  একাধিকবার হামলা হয় বাবার ওপর।  কিন্তু  সফল হয় না।  বাবার শুভাকাঙ্ক্ষী, অনুরাগী এবং অনুগামী ও কিছু কম ছিল না।

বাবার এক পরম হৈতেষী সিনিয়র কমরেডের পরামর্শে আরো বড় হামলা হবার আগেই, বাবাকে অজ্ঞাতবাসে পাঠানো হয়।  সবাই মিলে চাঁদা তুলে নগদ তিনশো তিরিশ টাকা ওঠে।  তিরিশ টাকার টিকিট কাটিয়ে বাবাকে একটা ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। গন্তব্য তুন্ডলা,সুদূর উত্তর প্রদেশ। পরবর্তী কয়েক মাস তুন্ডলায় বাবা এক প্রবাসী বাঙালি দম্পতির হোটেলে পেটভাতায় কাজ করে চালায়।

বাবা হাত ফসকে বেড়িয়ে যাওয়ায়, প্রতিপক্ষ ক্ষোভে উন্মাদ হয়ে যায়।  জেঠু সদ্য কেমিস্ট্রীর অধ্যাপক হিসাবে স্থানীয় কলেজে যোগ দিয়েছে।  তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে জেঠুর কোন যোগ ছিল না। শৈশবে ঠাকুমাকে নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জেঠু, যে জীবনে রাজনীতিতে জড়াবে না। আসলে কি জানেন? আমাদের ব্যাঁটরার চাটুজ্যে বাড়ির ছেলেমেয়েদের ওপর অভিশাপ আছে।  সকলেই কখনও না কখনও জেলে গেছে এবং প্রতি প্রজন্মে একজন ছেলে শহীদ হয়েছে। বাবার ছোট কাকা "ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়" আন্দোলনে শহীদ হন।  ওণার অত্যাচারিত  বিকৃত শব যখন আমাদের উঠোনে আনা হয়, জেঠু তখন চার বছরের শিশু।  ছোটদাদুকে ঐ অবস্থায় দেখে আতঙ্কিত ক্রন্দনরত ঠাকুমা নিজের জেষ্ট্য পুত্রকে দিব্যি দেন, “ রাজনীতি করলে মায়ের মরা মুখ দেখবি”।  জেঠু সত্যই জড়ায়নি। কিন্তু পারিবারিক অভিশাপ এত সহজে কি যায়?

কলেজ থেকে ফিরে, সেদিনও জেঠু বলেছিল,“ মা মুড়ি মাখ। আচারের তেল দেবে কিন্ত। ” মুখ হাত ধুয়ে খেতে বসবে, হঠাৎ জেঠুর এক সহকর্মী  ডাকতে এল। “ আসছি।  এখুনি। ” বলে বেড়িয়ে গেল জেঠু। আর ফেরেনি। ঠাকুমা বসেছিল, সারা রাত।  সারা দিন। তার পরের দিন।  হয়তো তারও পরের দিন।  আরো কতদিন জানি না।  বাবা ফিরে আসে।  হৈতেষীদের নিষেধ সত্ত্বেত্ত বাবার ফিরে আসাটা ছিল সাংঘাতিক ভুল।
ভুলের মাসুল দেয় গোটা চাটুজ্যে পরিবার । [চলবে]
#aninditasblog

Tuesday 22 December 2015

অনির ডাইরি ১৮ই ডিসেম্বর, ২০১৫


ফেসবুকে আমার এক বয়স্ক বন্ধু আছেন, ষাটোর্ধ, অবসর প্রাপ্ত, কৃতি সন্তানের জনক। সাম্প্রতিক বড়ই নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলেন। বয়স্কা স্ত্রী তো ঘরকন্যা, পুজোআচ্ছা আর টেলিভিশনে প্যানপ্যানে বাংলা সিরিয়াল নিয়ে দিব্যি দিনযাপন করেন, কিন্তু আমার বন্ধুটির সময় আর কাটছিলই না। কাঁহাতক বই, পত্র আর খবরের কাগজ পড়ে থাকা যায়, ফলতঃ উনি খুব দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। আচমকা সুগার, প্রেসার, রক্তে স্নেহ পদার্থের আধিক্য দেখা দিল। সাথে দেখা দিল তুমুল গৃহবিবাদ। গিন্নি বাড়িতে মিষ্টি ঢোকা বন্ধ করে দিলেন, বেপরোয়া বন্ধুটি পাড়ার মিষ্টির দোকানে খাতা খুললেন। নিন্দুকে বলতে লাগল, পাড়ার তেলে ভাজার দোকানেও ওনার নাকি খাতা আছে। নিন্দুক গণ শুধু আলোচনা করেই ক্ষান্ত হলেন না, সময় মত গিন্নি মার কানে কথা গুলি তুলেও দিলেন। পরিণাম সহজেই অনুমেয়। ব্যাপারটি যখন বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে এগোচ্ছে, ভদ্রমহিলা আমাকে ঢেকে পাঠালেন, উদ্দেশ্য সাধু। এক স্বঘোষিত নারীবাদীর কাছে, ডোমেস্টিক ভায়লেন্সের বর্ণনা দেওয়া। কিন্তু মুস্কিল হল, যে, নারীবাদীরা আবার সাম্যবাদীও হন কি না। তাই সব শুনে আমার মনে হল, এ ক্ষেত্রে ভদ্রলোকটিই অধিক অত্যাচারিত। যদিও ভালবাসার অত্যাচার, তবুও-----।
ভদ্রলোকের নিঃসঙ্গতা কাটাতে আমিই ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলার পরামর্শ দি। প্রথম দিকে ব্যাপারটা বেশ ভালোই ছিল। দ্রত ওনার বন্ধু সংখ্যা বাড়ছিল। গৃহ যুদ্ধ ও সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে গেল, যদিও চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলতে লাগল। তবে ওটা ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই ভাল। ভদ্রলোকটি প্রথম গোল বাঁধালেন, বয়সজনিত সরলতা হেতু কিছু লোককে নিজের মোবাইল নম্বর প্রদান করে। কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন বয়সী সমকামী পুরুষ ওনাকে প্রেম প্রস্তাব পাঠাতে লাগল। কেউ কেউ মোবাইলে ফোন তথা হোয়াটস অ্যাপ এর মাধ্যমে সকাল বিকাল, “হ্যালো ডার্লিং” বলে মেসেজ/ ফোন করতে লাগল। মধ্যবিত্ত মধযব্যস্ক বাঙালির জানা সমস্ত গালাগাল প্রয়োগ করেও নিষ্কৃতি মিলছিল না। অগত্যা আমার শরণাপন্ন হন এবং উকুন বাছার মত করে একটি একটি করে লোককে আমি ব্লক করতে বাধ্য হই। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ঐ সমকামী পুরুষ গুলি শুধু যে ভারতীয় ছিলেন তা নয়, আমাদের একাধিক প্রতিবেশী দেশ থেকেও উনি প্রেম প্রস্তাব পান। ইংরাজি হরফে বেশ কিছু দুদ্ধর্ষ উর্দু কবিতা পড়ার সৌভাগ্য হয় ওনার কল্যাণে। বেশ কিছু দিন অ্যাকাউন্টটি ডিঅ্যাক্টিভেটেড থাকে।
পুজোর পর আমার এবং ওনার অন্যান্য বন্ধু বান্ধব তথা ভাইপো ভাইঝি দের সনির্বন্ধ অনুরোধে উনি পুনরায় ফেসবুকে ফিরে আসেন। তারপর আর খোঁজ নিইনি। মাঝে আবার একদিন উনি  ফোন করে বললেন, আবার উনি প্রেম প্রস্তাব পাচ্ছেন। তবে এবার মহিলা দের থেকে। বুঝতে পারলাম না, এতে আপত্তির কারণ কি? বৃদ্ধ বয়সে ভুরি ভুরি প্রেম প্রস্তাব তো বহু লোকের স্বপ্ন। অভিনন্দন জানাতে গেলাম, বৃদ্ধ গেলেন ক্ষেপে। ওনার বক্তব্য হচ্ছে, একজন বিরল কেশ, স্ফীতোদর, প্রায়অন্ধ লোকের প্রেমে পড়ার কি কারণ থাকতে পারে? শুধু তাই নয়, “প্রেম ছাড়, এদের সাথে দুদণ্ড কথাও বলা যায় না। বাঙালির হল কি?” উনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “ কেতাবি জ্ঞানের বাইরে এরা কি কিছু পড়াশোনা করে না? এত আকাট?  তুমি কেমন আছ? আমি ভাল আছি এর বাইরে কথা বলতে, আই লাভ ইউ। এর থেকে তো তোর কাকিমার সাথেই প্রেমের চেষ্টা করা ভাল।” হাসি চেপে বললাম, “ আনফ্রেন্ড করে দিন।”
সে যাত্রা বাঁচলেও, আজ আবার ফোন। বেশ রোম্যান্টিক আবহাওয়া। ভাবছি সন্ধ্যা বেলা এক চক্কর হেঁটে আসব, ইচ্ছা দমন করে ফোন ধরলাম। উনি উত্তেজিত ভাবে বললেন, “ আমার অ্যাকাউন্টটা ডিলিট করে দে। পাসওয়ার্ড তো জানিস।”
দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম, “আবার কে প্রেম নিবেদন করল? ধন্য ভাগ্য আপনার। এত প্রেম প্রস্তাব তো আমিও পাইনি।” উনি খিঁচিয়ে উঠলেন, “ না না। ও সব প্রেম ট্রেম না। আমি সামগ্রিক ভাবে বাঙালি জাতির ওপর বীতশ্রদ্ধ। এপাড় ওপাড় মিলে, হাতে গোনা কয়েকজনএর লেখা (অর্থাৎ স্ট্যাটাস) পড়লে মনে হয়, সত্যি আমরা বাঙালি। বাকি গুলো অখাদ্য। রোজ সকালে ফেসবুক খুললেই, খালি ছবি (পড়ুন সেলফি)। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সব এক পোজে, ঘাড় হেলিয়ে, চোখ টেরিয়ে, দাঁত কেলিয়ে ছবি।” এই রে প্রমাদ গুনলাম। লাস্ট সেলফিটা যেন কবে দিলাম? আজকেই কি? উনি না থেমে বলেই চললেন, “আর না হলে কবিতা। বাপস্। ও গুলো কি? কবিতা? আর মাঝে মাঝে বামপন্থার মা-বোন এক করা। বিন্দুমাত্র পড়াশোনা নেই। মার্ক্সের নাম ছাড়া কিছু জানে না। সেও নাকি বামপন্থী। জাতটা নষ্ট হয়ে গেছে বুঝলি। সামগ্রিক অবক্ষয়।”
কোনমতে ওনার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে, হাঁটতে বেরোলাম। হেডফোন লাগিয়ে, রেডিও চালিয়ে হাঁটতে দিব্যি লাগছিল। শিরশিরে হাওয়া। ফাঁকা ফাঁকা পথঘাট। রেডিওতে বিজ্ঞাপন চলছে, আমি হেঁটেই যাচ্ছি।দশ মিনিটের ওপর হয়ে গেল, একটিও গান শোনাল না। বেশ বিরক্তি লাগছে, চ্যানেল পাল্টাতেও ভয় করছে। পরেরটা আবার কতক্ষণ বিজ্ঞাপন দেবে কে জানে। এমনি বিজ্ঞাপন শেষ হয়ে রেডিওটিরই কোন শো এর বিজ্ঞাপন শুরু হল। এক মহিলা সহর্ষে বললেন, “সঙ্গে থাকবে, আর জে XYZ। যার গলা শুনলে, কাকও নিজের মাথায় পটি করে দেয়।” চমকে উঠলাম, বাপরে! কি সাংঘাতিক। যাই হোক। বিজ্ঞাপন শেষ, আর জে ফিরে এলেন, এক গাদা আজগুবি কথা বলে, একটা ফোন রিসিভ করলেন। সাগ্রহে লক্ষ্য করলাম, আপনির বালাই নেই। সবাই তুমি। এক মহিলা ফোন করেছেন, আর জে প্রশ্ন করলেন, “আজ সারাদিন কি করলে?”
“চপ বানালাম। ক্যাপ্সিকামকে কেটে”
“কি ভিতরে এঁটেল মাটি দিয়ে নাকি?” আর জের মন্তব্য শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না।
মহিলা অবশ্য লাস্যময় হেসে বললেন, উনি ভিতরে ফুলকপির পুর দিয়েছেন। অতঃপর উনি বললেন, “ জান আমার না খুব ইচ্ছে করছে, কুয়াশায় তোমায় কেমন দেখতে।” স্মার্ট (?) আর জে বললেন, “ আমার একটা ছবি নাও, আর ফটোশপে ব্লার করে দাও। না হলে সিগারেট ধরিয়ে আমার ছবিতে ধোঁয়া ছেড়ে দেখ। না হলে তোমার চশ্মার কাঁচটা ঘষে নাও, নিয়ে আমার ছবি দেখ।” মহিলাও বোধহয় আর নিতে পারলেন না। বোকা বোকা হেসে বললেন, “তাই করি।” ফোনটা কাটাতে আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। এর পরের ফোনটা একটা বাচ্ছা ছেলের (নাকি মেয়ের), সে উৎফুল্ল হয়ে বলল, “কাকু একটু লুঙ্গিড্যান্স গানটা চালাও না। আমি ওটা শুনতে খুব ভালোবাসি।” আর জে বললেন, “ হে হে তুমি লেপের তলায় বাবার লুঙ্গি ধরে ডান্স কর।” আর সহ্য করতে পারলাম না। রেডিও বন্ধ করে দিলাম। মনে হল আমার বন্ধুটি খুব ভুল কিছু বলেননি।
 
#AnirDiary #AninditasBlog http:/amianindita.blogspot.in

Tuesday 8 December 2015

নীলতারা

নীলতারা

বাতানুকূল কফিশপ, তাও কুলকুল করে ঘামছে সাদিক। নার্ভাস লাগছে প্রচণ্ড। ধপধপে সাদা সি থ্রু শার্ট আর সমুদ্র নীল জিন্স পরে, এক তোড়া টকটকে লাল গোলাপ নিয়ে অপেক্ষা করছে, তারার জন্য। কত বছর পর দেখা হচ্ছে? সতেরো? নাকি আঠারো? ক্লাশ ইলেভেনে ওদের স্কুলে এসে ভর্তি হয়েছিল তারা, পুরো নাম নীলতারা। ওরা ঠাট্টা করে ডাকত, “হাঁড়িয়া কালী” বলে। ডাকবে নাই বা কেন? ঘোর কৃষ্ণ বর্ণা, স্থূলাঙ্গী, হাঁড়ির মত গোল মুখ, হাসলে চোখ গুলো ঢেকে যেত। তারা অবশ্য কোনদিন রাগ করেনি, বরং হাসি মুখেই মেনে নিত। এমনকি প্রায়ই নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ করত। জনপ্রিয় হতে দেরি লাগেনি তারার। অচিরেই সাদিক আর তারা একে অপরের প্রিয়তম বন্ধু হয়ে ওঠে। টুয়েলভ পাশের পর, সাদিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল সেই পুনে। বাকি বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এল, তখন কোথায় মোবাইল, কোথায়ই বা ইন্টারনেট। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ল্যান্ড ফোন আর না হলে চিঠি।  চিঠির জবাব দেবার মত অবসর সাদিকের থাকত না, তারা তাই মাঝে মাঝে ফোনই করত। তারাদের বাড়িতে ফোন ছিল না। পিসিও থেকে করত। প্রথম দিকে ভালই লাগত সাদিকের, ক্রমে বিরক্ত লাগতে লাগল। কলেজের অন্যান্য বন্ধুরাও “ভাবির ফোন” বলে খেপাত। ভাবি? ঐ হাঁড়িয়া কালি ওর মানসী? ভাবতেই বিবমিষা জাগত। ঠারেঠোরে বোঝাবার চেষ্টা করত, এত আদিখ্যেতা ওর ভাল লাগে না। একদিন বলেও বসল, বন্ধুরা ওকে নিয়ে বাজে ঠাট্টা করে, তারা পাত্তাই দিল না। বিরক্তি জমছিল, মনে আছে, ফোর্থ ইয়ারে সবে উঠেছে, রেসাল্ট মনোমত হয়নি বলে এমনি মুড খিঁচরে ছিল, উপরন্তু জ্বর আর গোটা গায়ে বেদনার জন্য সেদিন ক্লাশে যেতে পারেনি। ঠিক দুপুর বেলা চোখটা সবে জুড়ে এসেছ, অফিস থেকে খবর দিল, ফোন এসেছে। ভেবেছিল মা, ফোন তুলে দেখে তারা। তেতো স্বরে সাদিক বলল, “তুই, এই অসময়ে?” তারা হেসে জবাব দিল, “ একটা চান্স নিলাম। ভাবিনি তোকে এই অসময়ে পাব, তবু” একটু দম নিয়ে তারা রহস্য করে বলল, “একটা কথা তোকে না বলে থাকতে পারছিলাম না রে।” গা রিরি করে উঠল সাদিকের। গ্লার স্বর উঁচু করেই জিজ্ঞাসা করল,“কি? দেখ তারা একটা কথা আজ পরিষ্কার শুনে রাখ, আমার থেকে কিচ্ছু প্রত্যাশা রাখিস না।” “মানে?” হতভম্ভ হয়ে বলল তারা, “ তুই কি বলছিস? আমি তো কিছুই বুঝতে-।” “ন্যাকামি রাখ। সব বুঝিস। শোন সবাইকে দেখে সব কিছু হয় না তারা।” গর্জন করে উঠল সাদিক। কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে তারা গ্লা ঝেড়ে বলল, “সাদিক আজ আমাদের রেসাল্ট বেড়িয়েছে। আমি ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছি রে। এই খবরটা তোকে না জানিয়ে থাকতে পারছিলাম না। ভুল বুঝিস না। ভাল থাকিস। ছাড়লাম।” আর কখনও ফোন করেনি তারা।

 অপরাধ বোধ কিছুদিন ছিল। ভাবত চিঠি লিখে ক্ষমা চাইবে। তারপর ধীরে ধীরে ভুলে গেল সাদিক। জীবন তেজিয়ান ঘোড়ার মত দৌড়তে লাগল। চাকরি, লাস্যময়ী প্রেমিকা, বিয়ে, ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট, বড় গাড়ি, পিতৃত্ব সুখময় জীবন। টিনটিন যখন সাত বছরের হঠাত সাদিক আবিষ্কার করল, সবটাই ভাঁওতা। মূর্খের স্বর্গ। রেহানা করজোড়ে অব্যাহতি চাইল। না করতে পারল না সাদিকও। ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক আঁকড়ে থাকা আর লাশের শয্যাসঙ্গী হওয়া আর টানা যাচ্ছিল না। কোন তিক্ততা ছাড়াই রেহানা চলে গেল, টিনটিনকে নিয়ে। মস্ত বড় ফ্ল্যাটে রয়ে গেল একা সাদিক। রেহানা না থাকায় যৌথ ই এম আই এর বোঝা টানা হয়ে উঠল দুষ্কর। বেচে দিল বিশাল ফ্ল্যাট, বড় গাড়ি,  ছোট্ট এক কামরার ফ্ল্যাটে সেই দুঃসহ রাত্রি গুলিতে সাদিক শুধু হিসাব নিকেশ করত। কেন এমন হল? সব অঙ্ক মিলে যাচ্ছিল নীলতারাতে এসে। তবে কি তারার মনস্তাপেই ঘর ভাঙল সাদিকের?
 ফেসবুকের দৌলতে তারাকে খুজে  বার করতে সময় লাগেনি। ভেবেছিল তারা ওর বন্ধুত্বের আহ্বান অগ্রাহ্য করবে, তারা কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই গ্রহণ করল ওকে। কলেজে পড়ায়, আজো অনুঢ়া। সাদিক ক্ষমা চাইল, তারা ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিল ওর অপরাধবোধ, বলল, “পাগল হলি নাকি? আমার কোন অভিমান নেই।তবে বিয়েতে বলিসনি বলে খুব রাগ হচ্ছে। ”পরের তিনটে মাস যেন চোখের পলকে কেটে গেল। সুপ্রভাত থেকে শুভরাত্রি পর্যন্ত ভায়া মোবাইল তারাই হয়ে উঠল সাদিকের সর্বক্ষণের সঙ্গী। তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা সব বলা যায় তারাকে। রেহানার সঙ্গে এই নৈকট্য কি ও সত্যি কোনদিন অনুভব করেছে?
 এত বছর পরেও তারাকে দেখেই চিনতে পারল সাদিক। মনটা একটু দমে গেল, রেহানার থেকে বেশ বেঁটে, রঙটাও_---। একটু মেকআপ তো করতে পারত। নিদেনপক্ষে একটু লিপস্টিক। তারা এসেই ওকে জড়িয়ে ধরল। ফ্রেন্ডলি হাগ। কেমন যেন খুশি হতে পারল না সাদিক। রেহানার পর তারা? তারা বকবক করতে শুরু করল, অল্পকালের মধ্যেই ঢুকে পড়ল সাদিকও। বেশ খানিক পর মনে পড়ল, ফুল গুলোর কথা। পাএর কাছে রাখা কাগজের ব্যাগ থেকে বার করে দিল যখন, তারা যেন ঝিকমিকিয়ে উঠল। এত মূল্যবান রক্ত গোলাপ এর আগে পেয়েছে বলে মনে হল না সাদিকের। ভেবেছিল হাঁটু গেড়ে বসে প্রকাশ করবে নিজের মনের ভাব, কিন্তু—নাঃ থাক। বসে বসেই তারার হাতটা ধরল, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল নীলতারা, সাদিক চোখ বুজে একটু দম নিয়ে বলল, “ তারা, বহুদিন আগে করা একটা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। বিগত তিন মাসে আমি বুঝে গেছি, তোর থেকে ভাল আমায় কেউ বোঝে না। আমি তোর সঙ্গেই সবথেকে ভাল থাকি-”। ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিল তারা, “ কি করে বুঝলি? হোয়াটস্ অ্যাপে চ্যাট করে?” সাদিক ঘাবড়ে গেল। আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলতে গেল, কিন্তু ততক্ষণে ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পরেছে তারা, “ তুই আজো আমায় ভুল বুঝলি সাদিক। সিম্প্যাথেটিক রিলেশনের জন্য আর কাউকে পেলি না রে?” সাদিক ওর হাতটা চেপে ধরে কাতর ভাবে বলল, “তারা আমি সত্যিই তোকে......”
“কি? ভালবাসিস না। আমি জানি। আর যদি বাসিসও আমি বাসি না।”
“কেন তারা?”
“কেন? ভুলে গেলি? সবাইকে দেখে সবকিছু হয় না! চলি। ভালো থাকিস। যোগাযোগ রাখিস না।”
http:/amianindita.blogspot.in