Friday 13 March 2015

এমনও বসন্ত দিনে......



মার্চ মাস। সবে দোল গেল। ভাল করে খুঁজলে এখনও কিছু বিচ্চু ছেলের গায়ে দোলের আবছা রঙ পাওয়া যাবে। রাস্তার ধারে ধারে পলাশ, কৃষ্ণ আর রাধাচূড়া সোচ্চারে ঘোষণা করছে এটা মধু মাস। বসন্ত এসেছে।
          চয়ন অর্থাৎ চয়নিকা আজ বেশ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেড়িয়েছে। সেক্টর ফাইভের নামজাদা বেসরকারি দপ্তর। সন্ধ্যা ৬ টা না বাজলে কেউ ছাড় পায় না। আর চয়নের মত সিনিয়র হলে তো রাত ৭.৩০ এর আগে অফিস ছাড়া অসম্ভব। প্রচণ্ড কাজের চাপ।আজ বিশ্রী রকম ঝগড়া করতে হল। কিছু করার নেই। দোলার জরুরী তলব। কোন কথা শুনতে চাইল না। দোলা অর্থাৎ দোলনচাঁপা অপেক্ষা করছে কলেজ স্ট্রীট কফি হাউসে। কি প্রয়োজন কে জানে? তবে চয়নকে আসতেই হবে।
          দৌড়তে দৌড়তে ৪টের সময় গিয়ে পৌছল চয়ন। বব কাট চুল, জিন্স, পাজ্ঞাবি আর ঢোলা শান্তিনিকেতনী ব্যাগে পাক্কা আতেল। গলায় সবসময় ক্যামেরা ঝোলে। দোলার নির্দেশ মত তিন তলায় উঠে দেখতে পেল ভ্রু কুঁচকে বসে আছে দোলা। ওরা একই  স্কুলে পড়ত। ভ্রু যুগল সোজা রাখলে দোলা রীতিমত সুন্দরী। প্রতিমার মতো মুখ। কাঁচা হলুদের মত গায়ের রঙ। ভারি চেয়ারা। লম্বা চুল। হাল্কা রঙের শাড়ি বা সালয়ার ছাড়া কিছু পড়ে না। চূড়ান্ত রক্ষণশীল এবং বদমেজাজি। নামি বাংলা কাগজের সাব-এডিটর। কিছু কবিতার বই ও বেড়িয়েছে। ওরা দুজনেই মধ্য ত্রিশ। অবিবাহিতা।
          চয়নের বিয়ের কথা কেউ ভাবে না। ওকে মেয়ে বলেই কেউ গণ্য করে না। চিরকালের ডানপিটে, পাড়ায় প্রচণ্ড জনপ্রিয় চয়ন। সবার বিপদে আপদে সব সময় হাজির। ওর এই ছেলেদের মত পোশাক আর হাবভাবের জন্য স্কুলে ওর নামে নানা রকম গুজব ছড়াত। সে সবে কান দেবার বান্দা চয়ন নয়। স্কুলে ওর প্রিয় বান্ধবী ছিল তিস্তা। হরিহর আত্মা যাকে বলে। মেয়েরা  ঠারেঠোরে দুজনকেই খোঁচা দিত। গুজবটা জমে ক্ষীর হবার আগেই জানা গেল যে, তিস্তার এক জন প্রেমিক আছে এবং চয়ন ওদের দূতী। স্কুল শেষ হতে না হতেই তিস্তা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে বসলো সেই বাচ্চা প্রেমিক নয় বরং এক মধ্য বয়সী পুলিশ কনস্টেবলকে। চয়ন প্রতিজ্ঞা করলো আর তিস্তার মুখ দেখবে না। কিন্তু থাক সে এক অন্য গল্প।    
          মাঝখান থেকে চয়নের নামে গল্প গুলো বন্ধ হয়ে গেল। দোলা চিরদিনই ওর বন্ধু ছিল কিন্তু এই সময় ওদের সম্পর্ক আরও ঘণ হয়। স্কুলের শেষে শুরু হল জীবন সংগ্রাম।বাকি বন্ধুরা কে কোথায় ছিটকে গেল, কিন্তু ওদের বন্ধুত্ব আজো অটুট। তিস্তা ফিরে আসে এবং আজো ঘোরতর ভাবে উপস্থিত, কিন্তু চয়ন আর দোলার মাঝে ঢুকতে পারেনি।  অবশ্য নিন্দুকে বলে চয়ন হল দোলার তল্পিবাহক বা বাহিকা। দোলার জন্য পরীক্ষার আগে বন্ধুদের বাড়ি গিয়ে নোট নিয়ে আসা,  চিকেন পক্সের দাগ তোলার জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধ আনা, দোলার সব কবিতা শুনে মতামত দেওয়া (যদিও সবাই জানে চয়ন কবি দেখলেই ভয় পায়), দোলার প্রিয় লেখকের বই পড়ে সুচিন্তিত মতামত দেওয়া (যদিও সবাই জানে চয়ন বই দেখলেই আতঙ্কে ভোগে), দোলার সাথে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়ে ফরাসী ফিল্ম দেখা ( সেবার চয়ন ঘুমিয়ে পড়েছিল) সবেতেই চয়ন।
চয়নের হবি ছবি তোলা। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে যে চয়নের মত দোলার ছবি কেউ তুলতে পারে না। চয়নের ফেসবুক,ইন্সটাগ্রাম ভর্তি দোলনচাঁপার সুগন্ধে। দোলার তা ঘোরতর নাপসন্দ। দোলা এক রহস্য যা চয়ন আনেক চেষ্টা করে ও সমাধান করতে পারে না। দোলা এই খুশি, ঝলমলে রোদ- ঝকঝকে নীল আকাশ, আবার পরক্ষণেই মুখ ভার- বজ্র বিদ্যুৎ সহ ভারি বৃষ্টিপাত। কড়া কড়া কথা, দাঁতখিঁচুনি, চোখের জল ।  মাঝে মাঝে দোলার ব্যবহার এত খারাপ হয় যে ওদের বন্ধুরা বলে, “ তুই কি ওর পাঞ্চিং ব্যাগ? ’’ চয়ন সাধারণত রাগে না। তবে রেগে গেলে গলতে চায় না। তখন দোলা শুরু করে তার বস্তাপচা প্যানপ্যানে আবেগের সুড়সুড়ি সাথে চোখের জল।। মাঝে মাঝে আত্মহত্যার হুমকিও দেয়। তখন চয়ন রেগে গিয়ে বলে, “ বিয়ে কর, করে বরকে জ্বালা। আমি আর নিতে পারছি না।” মাঝে মাঝে দোলার বাবা মা কেও বলতে ছাড়ে না,” কি করছ তোমরা? মেয়েটা বসে বসে বুড়ো হচ্ছে। বিয়ে দেবে না নাকি?’ অবশ্য এ গুরুদায়িত্ব চয়ন  স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। ওর সব বন্ধু, পরিচিতকে লাগিয়েছে দোলার জন্য সুপাত্র খুঁজতে। মধ্য তিরিশের উচ্চ শিক্ষিতা বাঙালী মেয়ের সুপাত্র পাওয়া দুষ্কর। তাও পাওয়া যায়। কিন্তু দোলার কাউকে পছন্দ হয় না। কি উন্নাসিক বাবা রে? এই নিয়েও ওদের বহু ঝগড়া হয়েছে। কি যে চায় দোলাটা??
তিন তলায় নির্দিষ্ট টেবিলে অপেক্ষা করছে দোলা। প্রায় বিবর্ণ একটা সুতির সালোয়ার পরেছে। লম্বা চুল বেণী বাঁধা। চয়ন টেবিলে ব্যাগ রেখেই পটাপট ওর ছহবি তুলতে তুলতে বলল, “বল? এত জরুরী তলব? বললাম অফিস ফেরত তোর বাড়ি হয়ে আসবো, তাও পছন্দ হল না।শালা তোর জন্য ঝগড়া করতে হল অফিসে।”
দোলা অন্যমনস্ক কি? বোঝা গেল না। এত জটিল ও। পরতে পরতে রহস্য। মৃদু হেঁসে বলল, “এই শেষ।”
চয়ন ওর সামনে মুখ খারাপ করে না। তাই সামলে নিয়ে কৌতুকের সাথে বলল, “মানে? হরিদ্বার যাচ্ছিস নাকি মামা?” দোলা চোখ পাকালো। চয়ন হাসতে হাসতে ক্যামেরাটা ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “নাকি বিয়ে করছিস?”
দোলা নিরুত্তর। চয়ন চমকে উঠলো। তাকালো দোলার দিকে। এক, দুই, তিন... কোনো কথা নেই। দোলা চোখ সরালো জানলার দিকে। ফাল্গুনের পড়ন্ত রোদ, গলা সোনার মত ছড়িয়ে আছে মাটিতে।
উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লো চয়ন, “শালা...এই আমি তোমার বেষ্ট ফ্রেন্ড? চুপচাপ গুপগাপ ??? এই জন্যই এত ডাকাডাকি? মিষ্টি খাওয়া। না দাড়া। ট্রিঙ্কাসে ট্রীট চাই।”
দোলা তাকালো ওর দিকে। চয়ন উত্তেজনায় ফুটছে। ওর আঙ্গুল গুলো নেচেই  যাচ্ছে টেবিলের ওপর । সব জানতে চায়। কে? কি করে? কবে থেকে? কত দূর গড়িয়েছে?
দোলা অদ্ভুত থেমে থেমে উত্তর দিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সুষুপ্তি আর জাগরণের মধ্যে আছে। “সুকান্ত। তোদের পাড়ায় থাকে।” আমি চাইনি। জানি না কেন?” দোলার কথা শেষ হবার আগেই চয়ন বলে উঠল, “ছাড় না মামু। এই ভাল” দীর্ঘশ্বাস চাপল কি কেউ? দু জোড়া কানই কি খাড়া হল? “সুকান্তদা কে চিনি। মাটির মানুষ। তোর কথায় কান ধরে ওঠবস করবে। আর” একটু থামল চয়ন “এবার আমার ছুটি।”
গলার স্বর কি পাল্টালো? তন্নতন্ন করে কি খুঁজছে ওরা একে অপরের অভিব্যক্তির গুলোতে? নাকি সবি মনের ভুল?
 

5 comments:

  1. Enjoyed it very much. Waiting for more from this promising writer.

    ReplyDelete
  2. Thank you so much for your kind words. I truly appreciate.

    ReplyDelete
  3. R u 'bubu' from Bargachia? Please reply.. Waiting.

    ReplyDelete